আপনি যদি দীর্ঘমেয়াদে- মানে ৫, ১০ বছর বা তারও বেশি সময়ের জন্য, কিছু মূলধন বিনিয়োগ করতে চান, তাহলে শক্ত আর্থিক মৌলভিত্তি এবং ভালো সুশাসন আছে এরকম লিস্টেড কোম্পানির শেয়ার আপনার জন্য খুবই উপযোগী হতে পারে| দীর্ঘমেয়াদে চক্রবৃদ্ধি হারে আপনার সম্পদ বৃদ্ধির সবচেয়ে উপযোগী মাধ্যম হতে পারে এসব কোম্পানির শেয়ার| কিন্তু সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ এবং ভালো কোম্পানির শেয়ার কেনার পরেও আপনি মূলধন হারাতে পারেন- বিশেষ করে যদি আপনি স্বল্প মেয়াদে বিনিয়োগ করে থাকেন সেক্ষেত্রে| যেহেতু লিস্টেড কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, সেহেতু তার জন্য যথাযথ বিশ্লেষণ এবং গবেষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ| এক্ষেত্রে কিছুতেই গুজব বা আবেগের বশবর্তি হয়ে তাড়াহুড়ো করে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না|
বিশেষভাবে মনে রাখবেন, আপনার মোট ব্যক্তিগত সম্পদের কেবলমাত্র একটা অংশ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করবেন- কখনোই আপনার মোট সম্পদের সম্পূর্ণটা বা মাত্রাতিরিক্ত অংশ ঝুঁকিপূর্ণ এই খাতে বিনিয়োগ করা ঠিক হবে না| আপনার যদি Finance/ Investment Management discipline-এ ভালো পড়াশোনা না থাকে বা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকে, তাহলে কিছুতেই ঋণ বা ধার করে বা মার্জিন লোন নিয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করবেন না|
আমাদের দেশের শেয়ারবাজারে ৩৭০ টিরও বেশি লিস্টেড কোম্পানি আছে| কিন্তু কোম্পানির গুণগত মান, সুশাসন এর মাত্রা এবং আর্থিক ভিত্তি বিবেচনায় বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগের উপযুক্ত না| কিন্তু কিভাবে একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী এই ৩৭০ টি কোম্পানির মধ্যে থেকে তার বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত কোম্পানিটি বেছে নিতে পারে? আমরা মনে করি নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো এক্ষেত্রে দিকনির্দেশনামূলক হতে পারে:
১. কোম্পানির সামগ্রিক গুনগত মান: কোন কোম্পানির শেয়ার কেনার মানে আসলে সেই কোম্পানির আংশিক মালিকানা কেনা। সুতরাং সেই কোম্পানির গুনগত দিকগুলোর সঠিক পর্যালোচনা একান্ত জরুরী- ঠিক যেমন আমরা একটি গাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে গেলে আমরা এর ডেভলপার বা প্রস্তুতকারী কোম্পানি, তুলনামূলক মান ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ব্যাপারে অনেক খোজ নেই – ঠিক তেমন। নিচের বিষয়গুলো বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবেঃ
ক. কোম্পানিটির পণ্য বা সেবা গুলো গ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয় কিনা (বা প্রতিযোগিতামূলক কিনা)- যেমন- স্কয়ারের ঔষধ, ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ, গ্রামীনফোনের ডেটা সার্ভিস ইত্যাদি। কোন কোম্পানির তাদের পণ্য বা সেবার মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা কতটুকু আছে, তা ওই কোম্পানির ব্যবসায়িক এবং আর্থিক সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ|
খ. কোম্পানিটির পরিচালকেরা কেমন– তারা আপনার পার্টনার হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য কিনা- এক্ষেত্রে আপনারা গুগল সার্চ করে দেখতে পারেন বা পরিচিত লোকজনের কাছ থেকে খোজ নিতে পারেন। কোম্পানির উদ্যোক্তারা এবং পরিচালকেরা কিভাবে কোম্পানিতে ভ্যালু অ্যাড করছেন তা সঠিকভাবে যাচাই করতে হবে|
গ. কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য সিনিয়র অফিসারদের দক্ষতা, সততা ও উদ্ভাবনীশক্তি কেমন– তাদের যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, ব্যবসায়ীক সাফল্য কেমন।
ঘ. বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনের মান কেমন– তাতে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য যথেষ্ঠ পরিমাণ তথ্য দেয়া আছে কিনা- দেশসেরা অডিটর দিয়ে অডিট করা হয়েছে কিনা।
ঙ. কোম্পানীটি সংখ্যালঘু শেয়ারহোল্ডারদের অধিকার যথাযথভাবে আদায় করছে কিনা– যেমন- বার্ষিক মুনাফার তুলনায় ল্ভ্যাংশ দেয়ার হার যথেষ্ঠ কিনা।
চ. প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের ধারণকৃত শেয়ার কেমন– পরিচালকদের ধারণকৃত শেয়ার কতখানি।
২. কোম্পানির (বিনিয়োজিত অর্থের উপর) মুনাফা করার ক্ষমতাঃ একটি কোম্পানী তার মুল্ধন বিনিয়োগ করে তার উপর যে হারে বার্ষিক মুনাফা লাভ করে, সাধারণত, সেই একই হারে ঐ কোম্পানীর শেয়ারমূল্য দীর্ঘমেয়াদে বাড়ে বা কমে। উদাহরন দিয়ে বলতে গেলে – স্কয়ার ফার্মার ফ্যাক্টরী এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল সম্পদগুলিতে যদি ঐ কোম্পানীর মোট ১,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ থেকে থাকে এবং তা থেকে যদি স্বংস্থাটি প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকা অপারেটিং মুনাফা বা নগদ প্রবাহ তৈরী করতে পারে, তবে স্কয়ার ফার্মার বিনিয়োজিত মুল্ধনের উপর মুনাফার হার ২০০/১০০০ বা ২০%। এর অন্য নাম Return on Invested Capital (ROIC)। তাই স্কয়ার ফার্মার শেয়ারহোল্ডার হিসাবে, আপনি দীর্ঘমেয়াদে এই ২০% হারেই রিটার্ন পাওয়ার প্রত্যাশা করতে পারেন। সুতরাং, কোন কোম্পানীর শেয়ার কেনার আগে, বার্ষিক আর্থিক বিবরনীর লাভ-ক্ষতি হিসাব থেকে তার ROIC হিসেব করে দেখে নিবেন (Income Statement থেকে Operating Profit নিয়ে তাকে Cash & Investment ছাড়া Total Asset দিয়ে ভাগ করে বের করে নিবেন)। আমরা মনে করি, যেসব কোম্পানীর ROIC বছরের পর বছর ১০% এর কম, সেসব শেয়ারে বিনিয়োগ করা বা দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখা ঠিক না।
৩. কোম্পানির মূল্ধন ব্যবহার করার দক্ষতাঃ যে কোম্পানী তার মুল্ধন বেশিরভাগ অংশ বেশি লাভজনক প্রজেক্টে বিনিয়োগ করতে পারে, তার শেয়ারহোল্ডাররা দীর্ঘমেয়াদে তত বেশি লাভবান হবেন। অন্যদিকে, কোন কোম্পানী যদি অনেক বেশি মুল্ধন স্বল্প লাভজনক বা অলাভজনক প্রকল্পে বিনিয়োগ করে তবে আগামীতে তার মুনাফা এবং শেয়ারমুল্য খুব ভালো না করার সম্ভাবনা বেশি (উদাহরন- ACI এর “স্বপ্ন” প্রকল্পের বিনিয়োগ) । যেসব ব্যাংক গত ১০ বছর মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল ব্যাংকিং প্রকল্পে বেশি মুল্ধন বিনিয়োগ করেছে তারা – যেসব ব্যাংক স্টক ব্রোকারেজ প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে তাদের চেয়ে মুনাফা ও শেয়ারমূল্যের দিক থেকে অনেক ভালো করেছে। সুতরাং, কোন কোম্পানীর শেয়ার কেনার আগে দেখতে হবে – তারা এখন কি ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে- সেই প্রকল্পগুলো কি কম মুল্ধন ব্যবহার করে কম সময়ে ভবিষ্যতে তুলনামুলক বেশি মুনাফা দিতে পারবে কিনা। মনে রাখতে হবে যে কোম্পানী ধারাবাহিকভাবে বেশি লাভজনক প্রকল্পে বেশি বিনিয়োগ করতে পারবে, তারাই শেয়ারহোল্ডারদের দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে বেশি লাভবান করতে পারবে।
৪. শক্তিশালী ব্যালান্সশিটঃ সাধারণত যেসব কোম্পানীর আর্থিক দেনা তার মোট সম্পদের তুলনায় অনেক বেশী হয় (৬০-৭০% বেশি), তার শেয়ারহোল্ডারদের পুজি হারাবার ঝুকি বেশি থাকে (যেমন- কেয়া কসমেটিক্স, বেশিরভাগ স্টিল রিরোলিং মিল ইত্যাদি)। সুতরাং, এধরনের কোম্পানীর শেয়ারে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
৫. অতিমুল্যায়িত দামে শেয়ার না কেনাঃ অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনলে, সবচেয়ে ভালো শেয়ার থেকেও তেমন ভালো ফল লাভ করা যায় না। তাই কোন শেয়ার কেনার আগে দেখতে হবে তার Price-to-earning ratio (ব্যাংকের ক্ষেত্রে Price-to-book value ratio) কত এবং তা অন্যান্য কোম্পানীর তুলনায় বা ঐ কোম্পানীর নিজের অতীতের গড় থেকে কতটা বেশি। মনে রাখতে হবে- শেয়ার বাজারে তাড়াহুড়ো করে বিশ্লেষণ না করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো করা যায় না।
Shonchoy.com লিস্টেড শেয়ারে বিনিয়োগের নির্ণায়ক সমূহ:
১. কোম্পানির কর্পোরেট গভর্নেন্স এবং ম্যানেজমেন্টের গুণগত মান মূল্যায়ন
২. একটি কোম্পানিতে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছে সেই ইন্ডাস্ট্রির বিশ্লেষণ এবং কোম্পানিটি ওই ইন্ডাস্ট্রিতে যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক কিনা তার মূল্যায়ন