কম ঝুঁকি ও নির্দিষ্ট পরিমাণ রিটার্নের নিশ্চয়তা থাকায় ব্যাংক এফডিআর বা বিভিন্ন রকমের ডিপিএস স্কিমগুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়| এফডিআর-এর মাধ্যমে এককালীন নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জমা রেখে মুনাফা অর্জন করা; অন্যদিকে বিভিন্ন ডিপিএস বা Deposit Pension Scheme-এর মাধ্যমে একজন আমানতকারী প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখে দীর্ঘমেয়াদে সঞ্চয়বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ থেকে ব্যতিক্রম এসমস্ত ফিক্সড ডিপোজিট ও ডিপিএস স্কিমে বিনিয়োগ করলে পূর্বনির্ধারিত এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা লাভ করা যায়| বাংলাদেশ এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ফিক্সড ডিপোজিট বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপোজিট ইন্সুরেন্স সিস্টেম (DIS) কর্তৃক বীমাকৃত – অর্থাৎ যদি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক আমানতকারীর অর্থ সময়মত ফেরত দিতে না পারে, সে ক্ষেত্রে আমানতকারীর এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্ষতি বাংলাদেশ ব্যাংকের DIS বহন করবে|
ফিক্সড ডিপোজিট আমানতকারীর জন্য জরুরি প্রয়োজনে বা বিপদের সময় আর্থিক সুরক্ষা দিতে পারে| ডিপিএস-এ বিনিয়োগের মাধ্যমে আমানতকারী উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রদেয় আয়করের পরিমাণ কমাতে পারে| কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিভিন্ন ব্যাংক বা ব্যাংক-বহির্ভূত ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনের ফিক্সড ডিপোজিট বা ডিপিএস-এ বিনিয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদে একজন বিনিয়োগকারীর মুনাফা অর্জনের হার সীমিত- বিশেষভাবে আয়কর এবং মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনার পরে|
মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা পরবর্তী স্বল্প মুনাফা হার সত্বেও, প্রত্যেক ব্যক্তি বিনিয়োগকারীর উচিত কিছু সঞ্চয় ভালো কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখা| বাংলাদেশে বর্তমানে ৬০ টিরও বেশি ব্যাংক এবং ৩০ টির বেশী ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ সকল ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের ফিক্সড ডিপোজিট এবং ডিপিএস প্রোডাক্ট আমানতকারীদের জন্য নিয়ে এসেছে- এদের একেকটির মুনাফার হার এবং ঋণমান অপরটির থেকে অনেক ভিন্ন| ফলে একজন সাধারণ বিনিয়োগকারীর তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ফিক্সড ডিপোজিট বা ডিপিএস স্কিমটি বেছে নিতে অনেক ক্ষেত্রেই কষ্ট হয়| সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিম্নোক্ত সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করে এই কাজটি সহজেই করতে পারবেন:
১. মন্দ বিনিয়োগের ঝুঁকি কমাতে ঋণমান বিশ্লেষণ: আমরা অনেক সময়ই যে ব্যাংক বেশি সুদ হার অফার করছে সেই ব্যাংকে টাকা রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এক্ষেত্রে ঝুঁকির ব্যাপারটা আমরা সঠিকভাবে বিবেচনা করি না। এটা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে সব ব্যাংকের সক্ষমতা একই রকম না। অর্থাৎ কিছু ব্যাংকে টাকা রাখার ক্ষেত্রে আমানতকৃত অর্থ যথাযথভাবে ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি আছে – একে অর্থনীতির ভাষায় বিনিয়োগের ঝুঁকি বলা হয়। যেই ব্যাংকের ঋণমান বা অর্থনৈতিক ভিত্তি যত ভালো বা বেশি, সেই ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা যথাযথভাবে ফেরত দিতে পারার সম্ভবনা তত বেশী। আর ঋণমান খারাপ হলে আমানতকারী সময়মতো অর্থ ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। সুতরাং যেই ব্যাংকের আপনি ফিক্সড ডিপোজিট বা ডিপিএস করতে চাচ্ছেন সেই ব্যাংকের অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং ঋণমান মূল্যায়ন করে- ঋণমান বেশি এরকম ব্যাংকে আপনার আমানত রাখুন। মনে রাখবেন ব্যাংকে টাকা রাখা মানে এই না যে আপনি নিশ্চিত ভাবে আপনার গচ্ছিত টাকা ফেরত পাবেন| কিছু কিছু আর্থিক সূচক একটি ব্যাংকের ঋণ মান ভালো কিনা এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা দিতে পারে যেমনঃ
ক) ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি আরোপিত ঋণমান: ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুলো প্রতিবছর তাদের আর্থিক অবস্থান নিরূপণের জন্য সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা BSEC-নিবন্ধিত ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মাধ্যমে নিজস্ব ঋণমান যাচাই করে| এসব ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি সামগ্রিক ব্যবসায়িক এবং আর্থিক দিক বিবেচনা করে আপেক্ষিকতার ভিত্তিতে, বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান জন্য স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদে ঋণমান সূচক নির্ণয় করে যা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ওই ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির ওয়েবসাইটে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রকাশিত হয়ে থাকে| এছাড়া বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো আর্থিক ভিত্তি এবং সুশাসন আছে এরকম কিছু ব্যাংক আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি যেমন Moodys, S&P বা Fitch Ratings ইত্যাদি দ্বারা নিজেদের ঋণমান যাচাই করে আমানতকারীদের জন্য প্রকাশ করছেন| কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফিক্সড ডিপোজিট বা ডিপিএস করার আগে একজন আমানতকারীর উচিত ওই প্রতিষ্ঠান-এর বর্তমান ঋণমান সম্পর্কে ধারণা নেওয়া এবং অপেক্ষাকৃত কম ঋণমানবিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান-এ আমানত রাখা থেকে বিরত থাকা|
খ) মূলধন পর্যাপ্ততা বিবেচনা করা: ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ডিপোজিটরের কাছ থেকে ধার করা অর্থ ব্যবহার করে ঋণ দেওয়াসহ অন্যান্য ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে| অর্থাৎ একটি ব্যাংকের সর্ব মোট সম্পদ যদি ১০০ টাকা হয়ে থাকে তবে ওই ব্যাংকের মালিকদের নিজস্ব মূলধন গড়ে ১২ টাকার মধ্যে থাকে এবং বাকি ৮৮ টাকা ব্যাংকটি তার ডিপোজিটরদের কাছ থেকে ধার করে থাকে| এ কারণেই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সর্বোপরি আর্থিক ঝুঁকির পরিমাণ বেশি থাকে| কোন ব্যাংকের নিজস্ব মূলধন যত কম হয় বা ধার করা অর্থের উপর নির্ভরতা যত বেশি হয়, সেই ব্যাংকে আমানতকৃত টাকা ফেরত পাওয়ার ঝুঁকি তত বেড়ে যায়| সুতরাং আমানত করার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিজস্ব মূলধন এর পর্যাপ্ততা যথেষ্ট আছে কিনা তা জেনে নিতে হবে এবং তা যদি ৮% এর কম হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট উচ্চ ঝুঁকির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে|
গ) ম্যানেজমেন্ট এবং বোর্ডের গুণগত মান: ব্যাংকটির পরিচালকেরা কেমন- তারা আমানতকারীদের স্বার্থ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করছেন কি না, অতীতে ওই ব্যাংকের কোন আর্থিক কেলেঙ্কারি ঘটনা ঘটেছে কি না, ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্য সিনিয়র অফিসারদের দক্ষতা, সততা, যোগ্যতা, ব্যবসায়ীক সাফল্য কেমন, ব্যাংকটির বার্ষিক আর্থিক বিবরণী সুপরিচিত অডিটর কর্তৃক অডিট করা হয় কি না- এসব তথ্য বিবেচনায় আমানতকারীদের আমানতের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত|
২. আমানতের বিপরীতে বার্ষিক সুদ বা মুনাফার হার: সাধারণত ঝুঁকি এবং সুদের হারের মধ্যে সম্পর্ক বিপরীত হয়ে থাকে অর্থাৎ যেই ব্যাংকের ঋণমান ভালো সেই ব্যাংক আমানতকারীদের কম সুদের হার অফার করে| আর যেসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা শোচনীয় তারা অনেক বেশি সুদ দিয়ে হলেও আমানত আকৃষ্ট করে ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করে| তাই শুধুমাত্র বেশি সুদ দিচ্ছে এ কারণেই একটি নির্দিষ্ট ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট বা ডিপিএস হিসাব খোলা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না| সুতরাং আপনি কতটুকু ঝুঁকি নিতে পারবেন সেই বিবেচনায় সঠিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করে, সঠিক ডিপোজিট প্রোডাক্টটিতে আমানত রাখাটাই উপযুক্ত হবে| বেশি মুনাফার আশায় ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে আমানত রেখে আপনি আপনার কষ্টার্জিত মূলধন হারাতে পারেন|
৩. আমানতের মেয়াদ নির্ধারণ করা: যে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন মেয়াদের ডিপোজিট এবং ডিপিএস স্কিম অফার করে| একজন আমানতকারী যখন দীর্ঘমেয়াদি আমানত হিসাব খুলে সঞ্চয় করেন তখন তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ইন্টারেস্ট রেট রিস্ক নেন| ধরুন আপনি আজকে বার্ষিক ৭.৫% সুদে পাঁচ বছরের জন্য একটি ফিক্সড ডিপোজিট করলেন| এই আমানতটি রাখার এক বছর পর যদি ওই একই ব্যাংক একই প্রোডাক্টের জন্য বার্ষিক সুদের হার ৯% নির্ধারণ করে তাহলে আপনি প্রতি বছর ১.৫% কম মুনাফা অর্জন করবেন কারণ আপনার ফিক্সড ডিপোজিট এর জন্য পুরনো ৭.৫% সুদহারই প্রযোজ্য থাকবে| সুতরাং একজন আমানতকারী হিসেবে আপনি যদি মনে করেন আগামীতে সুদের হার বাড়বে তাহলে স্বল্পমেয়াদী আমানত রাখাটাই ভালো হবে| অন্যদিকে আপনি যদি মনে করেন আগামীতে সুদের হার কমে যেতে পারে তাহলে একটু দীর্ঘমেয়াদি আমানত রাখলেই আপনি বেশি লাভবান হবেন| আমরা মনে করি, আপনার মেয়াদি আমানতের টাকা স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদে ডাইভারসিফাই করে রাখাটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যথার্থ হয়|
৪. মেয়াদপূর্তির আগেই নগদায়নের ঝুঁকি নির্ধারণ: যেকোনো মেয়াদী আমানতের ক্ষেত্রে আমানতকারী যদি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তার জমানো টাকা তুলে নিতে চায় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সাধারণত কিছু জরিমানা বা অতিরিক্ত ফিস আরোপ করে| ডিপিএস প্রোডাক্ট এর ক্ষেত্রে নিয়মিত কিস্তি জমা না দিলে এরকম কিছু জরিমানা আরোপিত হয়| উভয়ক্ষেত্রেই আমানতকারীর আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন| সুতরাং যেকোনো মেয়াদি আমানত বা ডিপিএস হিসাব খোলার আগে তার মেয়াদ এবং কিস্তির পরিমাণ ঠিকভাবে নির্ধারণ করা জরুরী| সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে মেয়াদপূর্তির আগেই মেয়াদী হিসাবে জমাকৃত অর্থ তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে কি কি শর্ত প্রযোজ্য হবে তা যথাযথভাবে জেনে নিতে হবে|
৫. কর–সংক্রান্ত বিষয়াদি: আমানতকারীর যেকোনো ব্যাংক হিসাবে কোন এক আর্থিক বছরে কত টাকা Excise Duty হিসেবে কাটা হবে তা নির্ভর করে ওই ব্যাংক হিসাবের সর্বোচ্চ দৈনিক ব্যালেন্স এর উপর| একজন আমানতকারী এই বিবেচনায় যথাযথভাবে তার হিসাবের ব্যালেন্স মেইনটেইন করলে, Excise Duty হিসেবে আরোপিত করের বোঝা অনেকাংশে কমাতে পারেন| ধরুন আপনি ১২ লক্ষ টাকা কোন একটি মেয়াদী ব্যাংক হিসাবে জমা রাখতে চান; এক্ষেত্রে আপনি যদি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন হিসাবে চার লক্ষ টাকা করে জমা রাখেন তাহলে আপনি প্রতি বছর ২,১৬০ টাকার Excise Duty সাশ্রয় করতে পারবেন যা আপনার গচ্ছিত মূল অর্থের ০.১৮%.
পরিশেষে বলা যায়, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মেয়াদী আমানত বা ডিপিএস স্কিম বিনিয়োগ করার আগে শুধুমাত্র বেশি লাভের হার বিবেচনা না করে- এর পাশাপাশি উচ্চ ঋণমান বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সঠিক মেয়াদে কর-সাশ্রয়ী উপায়ে আমানত করার প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত|